সংবাদ শিরোনাম: |
বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাস আর ঐতিহ্য। তারই মধ্যে অন্যতম ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ বরিশাল। এ বিভাগের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। তারমধ্যে ঊল্লেখযোগ্য হচ্ছে লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, এপিফ্যানি গির্জা বা অক্সফোর্ড মিশন চার্চ, দুর্গাসাগর দিঘি, বিবির পুকুর, গুঠিয়া মসজিদ, ৩০ গোডাউন ও মুক্তিযোদ্ধা পার্ক। এসব নান্দনিক দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারো দর্শনার্থী বরিশালে আগমন করেন।বরিশাল শহরতলীর খুব কাছেই অবস্থিত চারশ বছরের পুরাতন লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি। এই বাড়ির অবস্থান শহর থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরে বরিশাল সদর উপজেলার লাকুটিয়া গ্রামে। বাড়িটিকে ঘিরে রয়েছে প্রায় চারশ বছরের পুরোনো ইতিহাস। এখানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন মঠ, সুবিশাল দিঘি, মাঠ এবং কারুকার্য মণ্ডিত জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়ির শিলালিপি থেকে জানা গেছে, প্রায় ১৭০০ সালে রুপচন্দ্র রায়ের ছেলে রাজচন্দ্র রায়ের হাত ধরে ইট, পাথর আর সুড়কির গাঁথুনিতে নির্মাণ করা হয় বাড়িটি। বাড়ির মূল প্রবেশপথের বাঁ পাশেই রয়েছে একটি পুকুর। পুকুরটিতে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন শান বাঁধানো সুন্দর একটি ঘাট। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে আছে। বাড়ির তিন ধারে রয়েছে ধানের জমি। বাড়ির কাছেই রয়েছে একটি আমবাগান। বাগানটির পাশেই রয়েছে বিশাল এক দীঘি। একে সবাই রাণীর দীঘি বলে। শীতের সময় এখানে অনেকেই পিকনিক করতে আসেন। বরিশালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পদ্মফুল ফোটে এই দীঘিতেই। রাজা রাজচন্দ্র রায়ের এ বাড়িটি উনিশ শতকেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের স্থান হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ছিল। কালের গর্ভে আজ তা শুধুই স্মৃতি।এপিফ্যানি গির্জা বা অক্সফোর্ড মিশন চার্চ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শৈল্পিক গির্জা। এর মূল নাম এপিফানী গির্জা হলেও স্থানীয় সাধারনের কাছে অক্সফোর্ড মিশন চার্চ নামেই বেশি পরিচিত। বরিশাল সদরের প্রাণকেন্দ্রে বগুড়া রোডে এর অবস্থান। ১১৩ বছর পুরনো দৃষ্টিনন্দন এ গির্জাটি ‘লাল গির্জা’ নামেও পরিচিত। এপিফানী গির্জার নির্মাণ কাজ ১৯০৩ সালে শুরু হয়। নির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকে বেশ কয়েক বছর । ১৯০৭ সালে দ্বিতীয় ধাপের কাজ শেষ হয়। এই কমপ্লেক্সকে কেন্দ্র করে এপিফানী ব্রাদারহুড এবং সিস্টারহুড সংগঠনের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ৩৫ একর জমির উপরে পুরো কমপ্লেক্সটি অবস্থিত। কমপ্লেক্সে আরো আছে তেরটি ছোট-বড় পুকুর, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আবাসিক ছাত্র ও ছাত্রী হোস্টেল, ফাদার ও সিস্টারদের আবাসন, পাঠাগার ও হাসপাতাল। গ্রিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এ গির্জার প্রধান আকর্ষণ বিশাল ও নান্দনিক প্রার্থনাকক্ষ। এমন স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের গির্জা আর দুটি চোখে পড়েনা। প্রায় পাঁচতলা ভবনের সমান উচ্চতার বিশাল স্থাপনা। নকশা কাজ তত্ত্বাবধান করেন ফাদার ই এল স্ট্রং। কাঠামোর প্রধান প্রকৌশলী ফ্রেডেরিক ডগলাস। পুরো কাঠামোটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রলম্বিত। প্রায় ৪২ মিটার লম্বা এবং ২২ মিটার চওড়া কাঠামোর সাথে পূর্ব দিকে অর্ধ-বৃত্তাকার একটি বর্ধিত অংশ সংযুক্ত। অর্ধবৃত্তাকার অংশের ব্যাসার্ধ প্রায় ৬ মিটার। পূর্ব-দক্ষিণ কর্নারে ঘণ্টা ঘর। এটি পরে তৈরী হলেও গীর্জার মূল নকশাকে অনুসরণ করে তৈরী হয়েছে। পশ্চিমে একটি আলাদা ছাদঢাকা করিডোর সংযুক্ত হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের কারণে এটি এখনো বেশ সুদৃশ্য এবং দৃঢ় অবস্থায় রয়েছে। আজও এর আদি ও অকৃত্রিম রূপের কোন পরিবর্তন ঘটেনি।লোকমুখে প্রচলিত যে, খ্রিষ্ট ধর্মের প্রখ্যাত প্রচারক ডা. উইলিয়াম কেরির নাতি উইলিয়াম কেরি জুনিয়র বরিশালে এসে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন স্থানীয় ভূস্বামিনী জিন্নাত বিবির শুশ্রুষায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরে জিন্নাত বিবিকে বিবি জেনেট নাম দিয়ে পালিত কন্যার মর্যাদা দেন উইলিয়াম কেরি জুনিয়র। ওই সময় স্থানীয়দের পানীয় জলের কষ্ট নিরসনের জন্য জিন্নাত বিবি একটি পুকুর খননে উইলিয়াম কেরি জুনিয়রের সহায়তা চান। সে অনুসারে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলা সদর বরিশাল শহরের প্রধান সড়ক সদর রোডের পূর্বপাশে ৪০০ ফুট প্রস্থ ও ৮৫০ ফুট দীর্ঘ একটি পুকুর খনন শুরু হয়। কাজটি ১৯০৮ সালে শেষ হয়। জিন্নাত বিবির কোন সন্তান ছিল না। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে তিনি বাস করতেন। ওই এলাকার নাম ছিল বিবির মহল্লা। পুকুরটিও কালক্রমে বিবির পুকুর হিসেবে খ্যাতি ও পরিচিতি লাভ করে। বিবির পুকুর বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী জলাধার। পরবর্তীতে জিন্নাত বিবির নামানুসারে শতবর্ষী পুকুরটি বিবির পুকুর নামে পরিচিতি পায়। বর্তমানে পুকুরটিতে একটি ঝুলন্ত পার্ক, বসার বেঞ্চ, ফোয়ারা এবং আলোকসজ্জা দিয়ে শোভা পাচ্ছে। এছাড়া বিবির পুকুরের পাশে উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র পাবলিক স্কোয়ার, যা বর্তমানে হিরণ স্কোয়ার নামে পরিচিত। বাংলাদেশের অন্য কোন বিভাগীয় শহরের প্রাণকেন্দ্রে এরকম জলাধার নেই এবং এটি বরিশাল নগরীর অন্যতম সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য বলে বিবেচিত।
বরিশাল শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে স্বরূপকাঠি - বরিশাল সড়কের মাধবপাশায় দুর্গাসাগর দিঘির অবস্থান। এটির শুধু জলাভূমির আকার ২৭ একর। পার্শ্ববর্তী পাড় ও জমিসহ মোট আয়তন ৪৫.৪২ একর। ১৭৮০ সালে চন্দ্রদ্বীপের পঞ্চদশ রাজা শিব নারায়ণ এই বিশাল জলাধারটি খনন করেন। তার স্ত্রী দুর্গামতির নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় দুর্গাসাগর। ১৯৭৪ সালে তৎকালিন সরকারের উদ্যোগে দিঘীটি পুনরায় সংস্কার করা হয়। বর্তমানে “দুর্গাসাগর দিঘীর উন্নয়ন ও পাখির অভয়ারন্য” নামে একটি প্রকল্পের অধীনে বরিশাল জেলা প্রশাসন দিঘীটির তত্ত্বাবধান করছে। সম্পূর্ণ দিঘীটি উঁচু সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। দিঘীর দুই দিকে প্রবেশের জন্য দুইটি গেট ও মাঝখানে জঙ্গলপূর্ণ একটি ছোট দ্বীপ আছে। গুঠিয়া মসজিদ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম জামে মসজিদ যা বরিশাল বিভাগে উজিরপুর থানার গুঠিয়া ইউনিয়নের চাঙ্গুরিয়া গ্রামে অবস্থিত। বরিশাল শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে ১৪ একর জমির উপর বিশাল এই মসজিদটি গড়ে তোলা হয়েছে। গুঠিয়া মসজিদ নামে পরিচিতি পেলেও এর নাম বাইতুল আমান জামে মসজিদ। ২০০৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর গুঠিয়া ইউনিয়নের এস শরিফ উদ্দিন আহমেদ সান্টু গুটিয়া বায়তুল আমান জামে মসজিদ এবং ঈদগা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ২০০৬ সালে গুঠিয়া মসজিদ ও ঈদগা কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। গুটিয়া মসজিদ কমপ্লেক্সের ভিতরে রয়েছে একটি মসজিদ, সুদৃশ্য মিনার, বিশ হাজার লোকের ধারণ ক্ষমতার ঈদগাঁ ময়দান, একটি ডাকবাংলো, এতিমখানা, গাড়ি পার্কিং, পুকুর, লেক এবং ফুলের বাগান। মসজিদটির মিনারের উচ্চতা প্রায় ১৯৩ ফুট। মসজিদটি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় একুশ কোটি টাকা। মসজিদের নির্মাণ শৈলীতে ইউরোপ,এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের নামকরা মসজিদের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। মসজিদটিতে উন্নত মানের বোস স্পিকার ব্যবহার করা হয়েছে। এই মসজিদটিতে মহিলাদের পৃথক নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অনন্য এই গুটিয়া মসজিদ দেখতে এবং নামাজ আদায় করতে প্রতিদিন হাজারো দর্শণার্থীর আগমন ঘটে। এছাড়াও মসজিদ কমপ্লেক্সে পবিত্র কাবা শরীফ, জমজম কূপের পানি, আরাফাত ময়দান, জাবালে রহমত, জাবালে নূর, নবীজির জন্মস্থান, মা হাওয়া এর কবর স্থান, খলীফাদের কবরস্থান অন্যান্য বিখ্যাত মসজিদ এবং বিখ্যাত জায়গার মাটি সংরক্ষণ করা আছে যা দর্শনার্থীরা দেখতে পারেন।বরিশালের অনেক নদীর মধ্যে কীর্তনখোলা নদী অন্যতম। বরিশাল শহর মূলত; এই নদীর তীরবর্তী।তাই অপূর্ব এই নদীর পাড়ে ঘোরার জন্য সুন্দর একটা জায়গা হলো ত্রিশ গোডাউন। রিভারভিউ পার্ক ও বধ্যভূমি। এখানে সরকারের অধীনে বড় বড় ত্রিশটি গোডাউন আছে যা যুদ্ধের সময় অস্ত্র রাখার কাজে ব্যবহৃত হতো।এভাবেই লোকমুখে এই জায়গার পরিচিতি। কীর্তনখোলা নদীর পাড় ঘেঁষে প্রসস্থ বাধঁ দিয়ে এর উপর রাস্তা বানানো হয়েছে। সাথে আছে বসার জায়গা। নদীর জির জির বাতাস ও কলতান শব্দ উপভোগ করতে আশেপাশের মানুষ সবসময় এখানে আসে। তাই এখানে পাওয়া যায় ফুসকা-চটপটি, চা, আইসক্রিম ও কফি শপের হরেক এরকম খাবার।বরিশাল নগরীর কোলাহল ও যানজট থেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও একটু স্বস্তি পেতে ভ্রমণ পিপাসু এবং নগরবাসীর মধ্যে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কীর্তনখোলা নদীর তীরবর্তী ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ পরিবেশের মুক্তিযোদ্ধা পার্ক। নগরবাসী অন্তত একবারের জন্য হলেও সবান্ধবে ঘুরে আসতে পারেন কীর্তনখোলা নদীর তীরবর্তী মুক্ত বাতাসের সিগ্ধ পরিবেশের এ পার্কে। এখানে ঘুরতে আসলে কীর্তনখোলা নদীর রূপ অবশ্যই মুগ্ধ করবে। দর্শনার্থীরা ইচ্ছে করলে স্পিড বোট অথবা পালতোলা নৌকা কিংবা ট্রলার ভাড়া করে কীর্তনখোলা নদী ভ্রমণ করতে পারবেন। মুক্ত বাতাস, ফুলের বাগান এবং মনোমুগ্ধকর সবুজের সমারোহ পার্কে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।
(পিআইডি ফিচার)
লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, পিআইডি, বরিশাল।