সংবাদ শিরোনাম: |
বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্প, যা দেশের আনাচে-কানাচে বিস্তৃত, আজ এক অলিখিত কালো অধ্যায়ের মুখোমুখি। এই অধ্যায়ের নাম স্থানীয় বিজ্ঞাপন বন্টনের অনিয়ম। তথ্য ও চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তর কর্তৃক কেন্দ্রীয়ভাবে বিজ্ঞাপন বন্টন না করার কারণে, স্থানীয় পর্যায়ে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সিভিল সার্জন অফিস, গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সহ বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের হাতে বিজ্ঞাপনের নিয়ন্ত্রণভার চলে গেছে। এই বিকেন্দ্রীকরণ, যা কাগজে-কলমে স্থানীয় উন্নয়নের স্বার্থে সুবিধাজনক মনে হতে পারে, বাস্তবে তা পরিণত হয়েছে এক ভয়াবহ অনিয়মের আখড়ায়, যা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে।
কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণের অভাব ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার:
যদি তথ্য ও চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তর সকল সরকারি বিজ্ঞাপনের কেন্দ্রীয় বন্টন নিয়ন্ত্রণ করত, তবে হয়তো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কিছুটা নিশ্চিত করা যেত। কিন্তু এই দায়িত্ব স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়ায়, ক্ষমতার অপব্যবহারের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বিভিন্ন অধিদপ্তর তাদের খেয়ালখুশি মতো বিজ্ঞাপন বন্টন করছে। এখানে পেশাদারিত্ব, পত্রিকার প্রচার সংখ্যা, পাঠকপ্রিয়তা বা সংবাদ পরিবেশনার গুণগত মান কোনো মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। বরং, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, রাজনৈতিক প্রভাব এবং আর্থিক লেনদেনই হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজ্ঞাপন পাওয়ার মূল চাবিকাঠি।
বিজ্ঞাপনের ফাঁদে আটকা পড়া সাংবাদিকতা:
এই অনিয়মের সবচেয়ে করুণ শিকার হচ্ছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। এক সময়ের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের কান্ডারিরা আজ বিজ্ঞাপনের আশায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দোরে দোরে ঘুরতে বাধ্য হচ্ছেন। সংবাদপত্রের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড দুর্বল হওয়ায়, স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল। এমন পরিস্থিতিতে, বিজ্ঞাপনের সামান্য আশাও তাদের জন্য বড় ভরসা। এর ফলে যা ঘটছে, তা হলো এক ভয়াবহ আপসকামিতা। যে সকল প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, তাদের অনিয়ম, দুর্নীতি বা অব্যবস্থাপনা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে স্থানীয় সাংবাদিকরা এক প্রকার নৈতিক চাপে পড়ছেন।
এই চাপ এতটাই তীব্র যে, অনেক সময় স্থানীয় সাংবাদিকরা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনিয়মের বিরুদ্ধে কলম ধরতে পারছেন না। তাদের সম্পাদক বা প্রকাশকও হয়তো পত্রিকার অর্থনৈতিক সুরক্ষার কথা ভেবে এই আপসকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলস্বরূপ, সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে সঠিক তথ্য জানার অধিকার থেকে। স্থানীয় দুর্নীতির চিত্র সমাজের সামনে আসছে না, ফলে জবাবদিহিতার অভাবে অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি শুধু সাংবাদিকদের পেশাগত নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বরং গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকেই দুর্বল করে দিচ্ছে।
অনিয়মের সর্পিল জাল: কেঁচো খুড়তে সাপ
স্থানীয় পর্যায়ে বিজ্ঞাপন বন্টনের অনিয়ম শুধু সাংবাদিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর জাল বিস্তৃত হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি পর্যন্ত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মোটা অঙ্কের বিজ্ঞাপন বাজেট বরাদ্দ রাখে, কিন্তু তার বড় অংশই চলে যায় অনিয়মের পথে। ভুয়া বিল ভাউচার, কম পরিচিত বা অস্তিত্বহীন পত্রিকাকে বিজ্ঞাপন প্রদান, কিংবা নির্দিষ্ট কিছু পত্রিকাকে বারবার বিজ্ঞাপন দিয়ে বাকিদের বঞ্চিত করা-এ সবই যেন সাধারণ ঘটনা।
এই অনিয়মের ফলে প্রকৃত অর্থে যে সকল পত্রিকা সংবাদ পরিবেশনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তারা বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে, কিছু তথাকথিত "হলুদ সাংবাদিকতা" নির্ভর পত্রিকা বা অনলাইন পোর্টাল কেবল বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভর করে টিকে থাকছে, যেখানে সংবাদ বা তথ্যের গুরুত্ব গৌণ। এটি সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকতার মানকে নিম্নগামী করছে এবং পেশার প্রতি মানুষের আস্থাকে ক্ষয় করছে। এই ধারা চলতে থাকলে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা বিলুপ্তির পথে চলে যাবে এবং তথ্যের বদলে গুজব আর অপতথ্যই সমাজে প্রাধান্য পাবে।
বাংলাদেশের সকল পত্রিকার দুর্দশা: এক অভিন্ন চিত্র
এই সমস্যা কেবল স্থানীয় পর্যায়ের ছোট পত্রিকার নয়। রাজধানী ঢাকার বড় পত্রিকাগুলোও স্থানীয় বিজ্ঞাপনের উপর এক ধরনের পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। যদিও তাদের আয়ের মূল উৎস বৃহৎ বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন, কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি বিজ্ঞাপনগুলো সেখানকার সাংবাদিকদের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। যখন এই বিজ্ঞাপন বন্টনে অনিয়ম হয়, তখন এর প্রভাব সারা দেশের সাংবাদিক সমাজেই পড়ে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পত্রিকা এখন অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল। কাগজের মূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রণ ব্যয় বৃদ্ধি, অনলাইন মিডিয়ার চ্যালেঞ্জ এবং পাঠক সংখ্যা হ্রাস-এই সব মিলেই সংবাদপত্র শিল্প এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, সরকারি বিজ্ঞাপনগুলো তাদের টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যখন এই বিজ্ঞাপনের বন্টন অনিয়মের বেড়াজালে আটকা পড়ে, তখন পত্রিকার অর্থনৈতিক দুর্দশা আরও প্রকট হয়। এর ফলে, তারা বাধ্য হয় ব্যয় সংকোচন করতে, যার প্রথম শিকার হন সাংবাদিকরা। কম বেতন, সময়মতো বেতন না পাওয়া, কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা-এই সবই এখন স্থানীয় সাংবাদিকদের নিত্যসঙ্গী। এই অর্থনৈতিক পরাধীনতা সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতাকে কেড়ে নিচ্ছে, যা দেশের সামগ্রিক সংবাদচিত্রের জন্য এক অশনি সংকেত।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বনাম অর্থনৈতিক পরাধীনতা:
একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী গণমাধ্যম গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ। যখন গণমাধ্যম অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিজ্ঞাপনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসের জন্য অনিয়মের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়, তখন তার স্বাধীনতা খর্ব হয়। সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের পরিবর্তে 'আপসকামী সাংবাদিকতা' করতে বাধ্য হন। এটি শুধু গণমাধ্যমের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য এক অশনি সংকেত।
যদি সাংবাদিকরা স্থানীয় পর্যায়ে ঘটে যাওয়া দুর্নীতি, অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারেন, তাহলে জনগণের দুর্ভোগ লাঘব হবে কীভাবে? সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে কীভাবে? এর ফলে, স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়তে থাকে এবং সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এই পরিস্থিতি গণতন্ত্রের শ্বাসরুদ্ধকারী এক পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হয় এবং ক্ষমতাবানদের স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি পায়।
সমাধানের পথ: কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতা
এই সমস্যার সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়, তবে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে এই অনিয়ম অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
১. কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও নীতিমালা প্রণয়ন: তথ্য ও চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তরকে সকল সরকারি বিজ্ঞাপনের কেন্দ্রীয় বন্টনের দায়িত্ব ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যেখানে পত্রিকার প্রচার সংখ্যা, পাঠকপ্রিয়তা, সংবাদ পরিবেশনার মান এবং নিরপেক্ষতা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বিজ্ঞাপনের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এটি বিজ্ঞাপনের সুষম বন্টন নিশ্চিত করবে এবং পক্ষপাতিত্বের সুযোগ কমাবে।
২. ডিজিটাল ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া: বিজ্ঞাপনের বরাদ্দ এবং বন্টন প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল ও স্বচ্ছ করতে হবে। কোন প্রতিষ্ঠানকে কত টাকার বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, তার বিস্তারিত তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করা উচিত, যাতে যে কেউ তা দেখতে পারে। এটি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে এবং অনিয়মের সুযোগ কমাবে, পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এক ধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি করবে।
৩. সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা: সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। যদি সাংবাদিকরা পর্যাপ্ত বেতন পান এবং কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষিত থাকেন, তবে তারা বিজ্ঞাপনের আশায় আপস করতে বাধ্য হবেন না। এর জন্য সরকারের পাশাপাশি সংবাদপত্র মালিকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। পেশাগত মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করতে এটি অপরিহার্য।
৪. সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধতা: সর্বোপরি, সাংবাদিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নিজেদের অধিকার এবং পেশাগত মান রক্ষার জন্য তাদের সোচ্চার হতে হবে। গণমাধ্যমকে তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে এবং সমাজের দর্পণ হিসেবে তার সঠিক ভূমিকা পালনে এই অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো অপরিহার্য। অন্যথায়, স্থানীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে আটকে, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা তার আলো হারিয়ে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকেই ধাবিত হবে।
গণমাধ্যমের এই মুখবন্ধ খুলে দিতে এবং তাকে প্রকৃত অর্থে জনগণের কণ্ঠস্বর করে তুলতে এই পদক্ষেপগুলো অপরিহার্য।
লেখক: মোঃ নেছার উদ্দিন, সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সাগরকূল, বরগুনা।